বুয়েটে আবরার ফাহাদের হত্যার পর সবাই ভেবেছিলো ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবার একটু হলেও থামবে। তবে না, ছাত্রলীগের কর্মকান্ড থামার বদলে এখনো চলছে আগের মতোই। কিন্তু এসব নিয়ে কথিত সুশীল সমাজের কোনো আপত্তি নেই। তাদের এই কর্মকান্ডের বিপরীতে কোনো শাস্তি নেই, আদতে এই সরকারের আমলে তাদের কোনো শাস্তির ব্যবস্থা নেই। আওয়ামীলীগের এই শাসনামলে ছাত্রলীগের অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বা হচ্ছে এমন ঘটনা খুবই কম, হাতে গোনা কয়েকটা। অথচ কথিত নাশকতা মামলায় দিনের পর দিন জেল খাটছেন বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীরা।
সামান্য সমাবেশ করার দায়ে পুলিশ নেতাকর্মীদের আটক করে রাখে দিনের পর দিন। আর ছাত্রলীগের এই অমানবিক কর্মকান্ডগুলোর পরেও কোনো শাস্তি নেই। এই প্রতিবেদনটা লেখার একটু আগেও পড়ে আসলাম কালবেলার দুইটা খবর। দুটোই ছাত্রলীগের সংঘর্ষের খবর। একটা শরীয়তপুরে এবং আরেকটা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুদিন আগে একটা প্রতিবেদনে দেখলাম পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীরা অফিসে ঢুকে এক কর্মকর্তাকে হেনস্তা ও হত্যার হুমকি দিয়েছে। এই ঘটনারও একদিন আগে কালবেলার এক প্রতিবেদনে দেখা মিললো বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রলীগ নেত্রী সাইমুনের অপকর্ম। হলে জুনিয়রদের রুমে ঢুকে রীতিমত হুমকি দেন, সভা-সমাবেশে যাওয়ার জন্য বাধ্য করেন। আরও কত কি!
তাদের অপকর্ম নিয়ে লিখলে দিন ফুরাবে তবে আমার লেখা ফুরাবে না। এই পনেরো বছরের আওয়ামী শাসনে দিনের পর দিন জেল খাটতে দেখেছি আমার আশপাশের নিরপরাধ মানুষগুলোকে। হাইস্কুলে যখন পড়তাম দেখতাম এলাকার কয়েকজন মিলে কোর্টে যাচ্ছেন মামলার হাজিরা দিতে। এই মামলাগুলো নিয়ে এখনো তারা দৌড়ের ওপর আছেন। নির্বাচন আসলেই শুরু হয় ধরপাকড়, এই ধরপাকড় এড়াতে দিনের পর দিন থাকেন আত্মগোপনে। তবুও তারা শাহজাহান ওমরদের মতো হাল ছাড়েন না, বুকে আশা নিয়ে এখনো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
২০১৯ সালের অক্টোবরে যুগান্তরে প্রকাশিত হওয়া এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে শেষ ১০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), বুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ (চবি) দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে লাশ হয়েছেন ২৪ জন শিক্ষার্থী। এই ২৪ জনের মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ জন, রাজশাহীতে ৫ জন, ময়আমনসিংহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন, দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ জন। এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও ৩ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আর এসব হত্যাকাণ্ডের ১৭টি ঘটেছে ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে।
দেশে যখন এই অবস্থা তখন তরুণেরা ভয় পায় সরকারকে নিয়ে কিছু বলতে। সরকারের নতুন নতুন আইন শুধু সাধারণ জনগনের বাকস্বাধীনতা দমনের জন্যই প্রতিষ্ঠা করা। ছেলের ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে মাকে দিনের পর দিন কারাভোগ করতে হয়। সরকারের সমালোচনা করলে খাদিজার মতো শিক্ষার্থীকে বিনা অপরাধে মাসের পর মাস জেল খাটতে হয়। সাংবাদিকরা সরকারের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করলে তাদের না পেয়ে তাদের মা-বোনের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। আরও কত কী!
সামান্য কয়েক কোটি টাকার মিথ্যা মামলা নিয়ে এখনো কারাবাসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। আবার এই দেশেই এস আলমের কোটি কোটি টাকা লুটের বিচার হয়না। কিংবা সাবেক ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর লন্ডনে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকার ব্যবসা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়না, কিংবা হবেওনা। আইনমন্ত্রী হাটতে বসতে যে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার বুলি শুনান সেই বিচার ব্যবস্থায় এক রাতে শাহজাহান ওমর জেল থেকে বের হয়ে নির্বাচন করেন। আর একই মামলায় আটক হওয়া মির্জা ফখরুল এখনো জেলে। এই হলো স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার নমুনা।
পুরোপুরি আওয়ামী সরকারের কাছে বিক্রি হওয়া এই প্রশাসনের ওপরও জনগণের এখন আস্থা নেই। যার দরুণ কোনো পুলিশ মারা গেলে মানুষ কমেন্ট বক্সে এখন আলহামদুলিল্লাহ লিখে। এই সংস্কৃতির শুরু হয়েছিলো একটা গোষ্ঠীর হাত ধরে। আল্লামা সাঈদীর মৃত্যুতেও যারা আলহামদুলিল্লাহ বলতো তাদেরও এখন গায়ে লাগে পুলিশের মৃত্যুতে আলহামদুল্লিলাহ পড়লে। অথচ একজন মুসলিমের মৃত্যুতে আরেক মুসলিমের খুশি হওয়া মোটেই কাম্য নয়, হোক সে যত বড় অপরাধী। জনগণের এখন এটুকুই আশা, দেশে গণতন্ত্র ফিরুক, বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন হোক, লুটেরাদের শাস্তি হোক, এই অগণতান্ত্রিক শাসনের ইতি ঘটুক। এটুকু আশা বুকে নিয়ে ঘুমন্ত এই জাতি নিশ্চয়ই একদিন বুঝে উঠবে যে, হাত গুটিয়ে বসে থেকে অধিকার আদায় করা যায় না। অধিকার আদায় করতে হয় বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে। জনগণের মনে এতটুকু উপলব্ধি যেদিন হবে সেইদিন যত বড়ই বন্ধুকের নল মুখের সামনে তাক করানো থাকুক না কেন, বুক ফুলিয়ে সামনে এগিয়ে সেদিন হয় সাধারণ মানুষ মরবে নয়তো রচিত করবে দেশের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়।