মানবাধিকারে মিশ্র বছর পার বাংলাদেশের-অ্যামনেস্টি

মানবাধিকারে মিশ্র বছর পার বাংলাদেশের-অ্যামনেস্টি

গেল বছর মানবাধিকার সুরক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রেকর্ড ছিল মিশ্র। একদিকে দেশটি প্রায় ১০ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার অর্জনের দিকেও এগিয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষেত্রে নাগরিকদের স্বাধীনতার উপর আক্রমণ থামেনি। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ নিয়ে এমনটা লিখেছে বিশ্বখ্যাত মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়া প্রতিবেদক সুলতান মোহাম্মেদ জাকারিয়া বলেন, ‘বাকস্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার অধিকার বিভিন্ন কালাকানুনের মাধ্যমে দমন করা হয়েছে। এসব কালাকানুন ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ সক্রিয়ভাবে সঙ্কুচিত করেছে। মত প্রকাশের কারণে বাংলাদেশের মানুষকে এখনও হয়রানি বা গ্রেপ্তার হতে হয়েছে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, দমনমূলক আইন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে ভিন্নমতালম্বী কণ্ঠস্বরকে ভয়ভীতি দেখিয়ে দমিয়ে রাখার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই আইনের অধীনে কমপক্ষে ২০ জন আটক হয়েছেন, মামলা হয়েছে প্রায় ৪০০টি। এই আইনে কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করার ক্ষেত্রে অবাধ সুযোগ দেয়া হয়েছে পুলিশকে। ফেব্রুয়ারিতে ৫ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা করা হয়। তাদের অপরাধ ছিল পুলিশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করা। এ ছাড়া গোয়েন্দা সংস্থার হাতে নাজেহাল হওয়া বা ভয়ভীতি প্রদর্শনের কারণে অনেক সাংবাদিক সেলফ-সেন্সরশিপ করতে বাধ্য হন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ‘বিকৃত’ ছবি প্রচারের অপরাধে র‌্যাব একজন অল্পবয়সী তরুণকে আটক করে। সাত বছরের সাজা দেয়া হয় তাকে। তবে পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। নির্বাচনী সভা, রাজনৈতিক সমাবেশ করতে দেয়া হয়নি বিরোধী দলগুলোকে। শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ ও সংঘবদ্ধ হওয়ার যে অধিকার রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর, তা লঙ্ঘণ করা হয়েছে। জুনে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর এক নেতার জানাজায় হামলা চালায়। এতে আহত হয় ছয় জন। সেপ্টেম্বরে পুলিশ অন্তত ১৪টি জেলায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)কে সভা করতে দেয়নি। অক্টোবরে ভারতের সঙ্গে হওয়া সরকারের একটি চুক্তির সমালোচনা করায় পিটিয়ে হত্যা করা হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে। সুলতান মোহাম্মেদ জাকারিয়া বলেন, ‘শাসক দলের ছাত্র সংগঠন যেই ভয়ানক কৌশল হাতে নিয়েছে তাতে দেখা যায় যে, যেসব মানুষ তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও কাজকর্মের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তাদের প্রতি সহিষ্ণুতা আছে সামান্যই। মতপ্রকাশের অধিকার, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার অধিকার চর্চার বিপরীতে ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে বাংলাদেশে। কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই মানুষের মতপ্রকাশ এবং ভয় বা নির্যাতনের আশঙ্কা ছাড়াই সমবেত হওয়ার অধিকারকে সম্মান করতে হবে, সুরক্ষিত রাখতে হবে।’

মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে নিরাপত্তা বাহিনী বিচারবহির্ভূত উপায়ে কমপক্ষে ৩৮৮ জনকে হত্যা করেছে। কিছুক্ষেত্রে অনেকে গুমের শিকার হয়েছেন। এর কয়েক মাস পর তাদের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যা করা হয়েছে। এর বাইরেও গত বছর ১৩ জনকে গুম করা হয়েছে।

নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে ৪৭৩২টি। এগুলোর মধ্যে ২৪৪৮টিই ধর্ষণ ও ৪০০টি ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে, ২৩২টি ধর্ষণের ঘটনা নথিবদ্ধ হয়েছে, যা ২০১০ সালের পর মাসভিত্তিক সর্বোচ্চ।

জাকারিয়া বলেন, ‘ফৌজদারি বিচার পদ্ধতির ব্যর্থতা, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধে ও দায়ীদের শাস্তি দিতে সরকারের অঙ্গীকারের অভাব- এসব বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে ভূমিকা রাখে। নারী ও মেয়েদের সব ধরনের সহিংসতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া উচিত।’ সেপ্টেম্বরে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ মোবাইল ফোন সেবাদাতা কোম্পানিগুলোকে শরণার্থী ক্যাম্পে নেটওয়ার্কের ফ্রিকোয়েন্সি বন্ধ করার আদেশ দেয়। এ ছাড়া নিরাপত্তা বাহিনী শিবিরের চারদিকে আরো কাঁটাতারের বেড়া স্থাপনের সুপারিশ করে। বাংলাদেশ কক্সবাজার জেলায় প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। আশঙ্কা ছিল যে এদের অনেককে হয়তো জোরপূর্বক মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে বা ভাষানচরে প্রেরণ করা হবে। রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের অভ্যন্তরে বিভিন্ন বিধিনিষেদের মুখোমুখি হয়েছেন। বিশেষ করে চলাচলের ক্ষেত্রে ও শিশুদের পড়াশুনার ক্ষেত্রে বাধা ছিল। এ ছাড়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হয়েছে। তাদেরকে দেশের বোঝা ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখানো হয়েছে।

মোহাম্মেদ জাকারিয়া বলেন, ‘সীমিত সম্পদ নিয়েও বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে উদারতার পরিচয় দিয়েছে। সামগ্রিকভাবে আমাদেরকে অবশ্যই নির্যাতিত এই সম্প্রদায়কে সহানুভূতির চোখে দেখতে হবে। তাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রস্থানের জন্য প্রত্যাবর্তন চুক্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা যেন এই দেশকেই নিজেদের বাড়ি মনে করে সেজন্য নিজেদের সাধ্যের মধ্যে সবটুকু করা উচিত।’

সূত্র: মানব জমিন

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *