এ কেমন বন্ধুত্ব?

এ কেমন বন্ধুত্ব?

ফেলানী! যে কিশোরীর নাম শুনলে গা শিউরে উঠে আমার, চোখের সামনে ভাসতে থাকে লাল জামা পরিহিত এক পরী ঝুলে আছে কাঁটাতারে। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি এই পরীকে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে বিএসএফ সদস্যরা গুলি করে হত্যা করে লাশ কাঁটাতারের বেড়ায় পাখির মতো ঝুলিয়ে রেখেছিল প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। এ ঘটনার ৩০ ঘণ্টা পর বিজিবির কাছে এই মরদেহ হস্তান্তর করেছিল বিএসএফ। নির্দোষ এই পরী হত্যার একযুগ পেড়িয়ে গেলেও সেই হত্যার বিচার হয়নি আজও। বিচারের পরিবর্তে উল্টো প্রতিবছর ডজন ডজন লাশ উপহার পাই আমরা। এই লাশের বিপরীতে আমরা কিচ্ছু বলি না, সরকারের ভাবসাব যেনো এমন ‘তোমরা যত পারো মারো, শেষমেষ আমায় যেনো ক্ষমতায় রাখো’। 

সর্বশেষ বিএসএফের গুলিতে বিজিবির এক সদস্যের মৃত্যুর পর এই সরকারের প্রতিনিধিদের কথা শুনে আমি পুরোপুরি থ হয়ে গিয়েছিলাম। বিজিবির এ সদস্যের মৃত্যুর পর এমপি-মন্ত্রীরা এটিকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দিলেন। এ ঘটনার পর ন্যূনতম প্রতিবাদ পর্যন্ত করেনি সরকার। অথচ বিএনপির মহাসমাবেশে পুলিশ হত্যার কি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে সরকার তা সবারই জানা।

ছবি: বিএসএফের গুলিতে নিহত হওয়ার পর এভাবেই ফেলানী খাতুনের মৃতদেহ কাঁটাতারে ঝুলে থাকে প্রায় ৫ ঘন্টা

সেই পরী (ফেলানী) হত্যার পর এক যুগ কেটে গেলেও এখনো থামেনি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত হত্যা। দেশটির সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে প্রতি মাসেই ঘটছে হত্যাকাণ্ড। অথচ দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে। মন্ত্রী-এমপি সবার মুখে এখন ভারত-ভারত রব। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেন, ভারতকে যা দিয়েছি সারাজীবন মনে রাখবে। অথচ সেই বন্ধু ভারত প্রতিবছর ডজন ডজন বাংলাদেশী মারছে সীমান্তে।  

বাংলাদেশ প্রতিবছর গড়ে ১৪ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে ভারত থেকে, বিপরীতে আমরা রপ্তানি করি মাত্র ১.৫ থেকে ২ বিলিয়ন ডলার। প্রতিবছরই ভারত অপরিকল্পিতভাবে তিস্তার পানি ছেড়ে দেওয়ায় বাংলাদেশের বন্যার সৃষ্টি হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কোটি মানুষ। এই তিস্তা চুক্তি বছরের পর পর ঝুলে আছে। দুই দেশের এতো ভালো বন্ধুত্বের পরও এত বছর ধরে ঝুলে থাকা এই চুক্তি নিয়ে বেশি মাথা ঘামান না সরকারদলীয় নেতারা। এত সমালোচনার পরও সরকার আদানি পাওয়ারের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনে, যেখানে আদানি কর ছাড়ের পাশাপাশি উচ্চ মুনাফা পায়। বিগত নয় মাসে আদানি পাওয়ারের মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৩০ শতাংশ বেড়েছে। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ আগামী ২৫ বছরের জন্য আদানি পাওয়ারের করের বোঝা বহন করবে, যে বোঝা ভারতীয় কোম্পানিটি তার সরকারের কাছ থেকে ছাড় পেয়েছে। কর ছাড়ের কারণে আদানির এক বিলিয়ন ডলারের চেয়ে বেশি অর্থ বেঁচে গেলেও বাংলাদেশকে কর দিয়ে যেতে হবে আগামী ২৫ বছর।

এই দুই বন্ধু দেশের সম্পর্ক নিয়ে লিখতে গেলে শুধু দেখা মিলে একপাল্লার লাভের ওজন ভারি। আরেক পাল্লার লাভের ওজন একেবারে বিপরীতে। পাল্লার এমন ব্যবধান যা আকাশ-পাতাল সমান। এ সম্পর্কে সবদিক দিয়ে ভারত লাভবান হলেও বাংলাদেশের কোনো লাভ নেই। লাভের পরিবর্তে বাংলাদেশ পায় লাশ। জনগণ হিসেবে আমরা উপকৃত না হলেও সরকার ঠিকই উপকৃত হয়। অনবরত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনে ভারতীয় হস্তক্ষেপের কারণে টিকে আছে আওয়ামীলীগ সরকার। যার পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্তে হত্যা থেকে শুরু করে যেকোনো বিষয়ে ভারতকে ছাড় দিয়েই যাচ্ছে এই সরকার। দেশের মানুষের স্বার্থে যেকোনো ঘটনায় ন্যূনতম প্রতিবাদ পর্যন্ত করে না এই সরকার। তাই জনগণের স্বার্থে সরকারকে এই নতজানু পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে আসা জরুরী। যদিও এর কোনো আশা নেই সামনে। তবুও জনগণ হিসেবে আমরা প্রতিবাদ করে যাবো, দেশের স্বাধীনতা রক্ষার্থে এই প্রতিবাদ করাটা আমাদের কর্তব্য। ইতোমধ্যে ভারতীয় পণ্য বর্জন করে বিএনপি এখন আলোচনার তুঙ্গে। ভারতীয় পণ্য কিনবেন কি কিনবেন না এটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে এই পণ্য বর্জন যদি ভারতীয় কর্তৃত্ববাদের বিপরীতে আপনার প্রতিবাদের ভাষা হয় তাহলে এই পণ্য বর্জন করাটা একজন বাংলাদেশী হিসেবে আপনার কর্তব্য বলে আমি মনে করি।

শেষকথা জীবনযুদ্ধে কাছের কোনো বন্ধু যদি আমার বিপদে এগিয়ে না এসে উল্টো তার প্রয়োজনে আমাকে ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলে দেয়, তবে এমন বন্ধু থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়। এই সরকারের উচিৎ জনগণের স্বার্থের কথা চিন্তা করে হলেও এই নতজানু পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে এসে জনগণ কি চায় সেটা বুঝা এবং তা অনুযায়ী কাজ করা।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *